ইহুদি জাতির ইতিহাস, উত্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি
ইহুদি জাতির ইতিহাস, উত্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি
ইহুদি জাতি কারা?
ইহুদিরা একটি জাতিগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়, যারা প্রধানত ইহুদি ধর্ম অনুসরণ করে। তাদের ইতিহাস হিব্রু বংশোদ্ভূত জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন কানান অঞ্চলে বসবাস করত। ইহুদি জাতির উত্স বিবেচনা করলে বাইবেলে উল্লিখিত হযরত ইবরাহিম (আ.) থেকে তাদের বংশধারার শুরু বলে মনে করা হয়।
ইহুদিদের উত্থান কিভাবে ঘটেছিল?
ইহুদিদের উত্থান মূলত তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, তারা বিভিন্ন সময় রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামী খেলাফত এবং ইউরোপীয় শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে, তারা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ইহুদিদের উপর নির্যাতন এবং তাদের দ্বারা নির্যাতিত কারা হয়েছিল?
ইতিহাসে ইহুদিদের উপর প্রচুর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
রোমান সাম্রাজ্যের সময় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন জারি হয়।
মধ্যযুগে ইউরোপে তাদের বিরুদ্ধে নানা নিপীড়ন ও গণহত্যা সংগঠিত হয়।
হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি জার্মানি তাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল (হলোকাস্ট)।
অন্যদিকে, ইহুদিদের দ্বারা ফিলিস্তিনি আরব, মুসলিম ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নির্যাতিত হয়েছে, বিশেষত ১৯৪৮ সালের পর থেকে, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটিশদের দখলে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। মূলত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী কূটনৈতিক চুক্তিগুলোর মাধ্যমে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
১. উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসন (১৫১৬-১৯১৭)
ফিলিস্তিন দীর্ঘ সময় ধরে উসমানীয় (অটোমান) সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ১৫১৬ সালে অটোমানরা মিশরীয় মামলুকদের পরাজিত করে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং প্রায় ৪০০ বছর ধরে তারা অঞ্চলটি শাসন করে।
২. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ব্রিটিশদের অভিযান (১৯১৭)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সময় অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সঙ্গে মিত্রতা করে, যা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ বাহিনী, বিশেষ করে জেনারেল এডমন্ড অ্যালেনবির নেতৃত্বে, অটোমান বাহিনীকে পরাজিত করে এবং ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণা জারি করা হয়, যেখানে ব্রিটিশ সরকার ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি "জাতীয় আবাসভূমি" প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়।
৩. সাইকস-পিকো চুক্তি (১৯১৬)
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স গোপনে সাইকস-পিকো চুক্তি করে, যার মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যপ্রাচ্যের অংশগুলোর ভাগাভাগি নির্ধারণ করা হয়।
ফ্রান্স লেবানন ও সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ব্রিটেন ফিলিস্তিন, জর্ডান ও ইরাকের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
৪. ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (১৯২০-১৯৪৮)
১৯২০ সালে লিগ অব নেশনস (জাতিপুঞ্জ) ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের উপর ম্যান্ডেট শাসন (অস্থায়ী প্রশাসন) পরিচালনার দায়িত্ব দেয়।
ব্রিটিশ শাসনকালে ইহুদিদের বিপুলসংখ্যক অভিবাসন ঘটতে থাকে, যা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং বহু বিদ্রোহের সূত্রপাত করে।
১৯৩৬-১৯৩৯ সালে ফিলিস্তিনিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যা ব্রিটিশরা কঠোরভাবে দমন করে।
৫. ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভক্তি পরিকল্পনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের হাতে এটি ছেড়ে দেয়।জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার পরিকল্পনা দেয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্র।ফিলিস্তিনিরা এটি প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু ইহুদিরা গ্রহণ করে।
৬. ব্রিটিশদের প্রত্যাহার এবং ইসরায়েলের জন্ম (১৯৪৮)
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটেন ফিলিস্তিন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়।একই দিনে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।এর ফলে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয় এবং ফিলিস্তিনিরা ব্যাপকভাবে বাস্তুচ্যুত হয় (নাকবা)।ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমানদের পরাজিত করে ফিলিস্তিন দখল করে এবং তাদের ম্যান্ডেট শাসনের অধীনে ইহুদিদের সেখানে বসতি স্থাপনের সুযোগ দেয়। পরবর্তীতে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে সরে গেলে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংকটের সূচনা করে।
ইসরাইলে ইহুদিদের স্থান গ্রহণের পটভূমি
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা জারি করে, যেখানে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন বিভক্তির পরিকল্পনা অনুমোদন করে, যার ফলে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী ভূমি থেকে আরব মুসলিমদের বিতাড়িত করা হয় এবং ইহুদিরা সেখানে বসতি স্থাপন করে।
গাজা দখল: ইসরায়েলের নীতি ও বৈধতা
ইসরায়েল গাজার উপর অবৈধভাবে দখলদারিত্ব কায়েম করতে চায়, যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এটি অবৈধ বলে বিবেচিত। ইসরায়েল দাবি করে যে, এটি তাদের প্রতিরক্ষার জন্য জরুরি, তবে বাস্তবে এটি ফিলিস্তিনি জনগণের ভূমি দখলের একটি প্রক্রিয়া।
ফিলিস্তিনি মুসলিমদের উপর ইসরায়েলের নির্যাতন
বোমা হামলা ও সামরিক অভিযান: ইসরায়েল নিয়মিত গাজা ও পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, যেখানে বহু নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।অবরোধ: গাজার উপর অর্থনৈতিক ও মানবিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার অভাব তীব্র।জমি দখল ও বসতি স্থাপন: ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে সেখানে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন করা হচ্ছে।মানবাধিকার লঙ্ঘন: ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও নিরীহ জনগণের উপর নিপীড়ন এবং নির্বিচার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।
উপসংহার:ইহুদিদের ইতিহাস যেমন নির্যাতন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তেমনি বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর তাদের দখলদারিত্ব ও নিপীড়ন চলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকারের জন্য সমর্থন জানাতে হবে।
✅আরো নিত্য নতুন সংবাদ পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।